
১. কুরআনের আয়াতসমূহ:
হজ ফরজ হওয়ার ঘোষণা:
“এবং মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উষ্ট্রের উপর চড়ে, যা আসে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে।” — সূরা হজ্জ, আয়াত ২৭
কেবলা সম্পর্কে নির্দেশনা:
“তোমরা যেদিক থেকেই আসো, সেই দিক থেকেই মুখ ফিরিয়ে মসজিদুল হারামের দিকে ফিরো।” — সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৪৯
কা’বা আল্লাহর ঘর:
“নিশ্চয়ই সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষদের জন্য নির্মিত হয়েছে, তা হচ্ছে বক্কায় (মক্কায়) যা বরকতময় এবং বিশ্বের জন্য পথনির্দেশ।” — সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৯৬
২. হাদীসসমূহ:
হজ ইসলামের স্তম্ভ:
“ইসলাম পাঁচটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত—… হজ পালন করা এবং কা’বার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করা।” — সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮
হজের ফজিলত:
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করে এবং অশ্লীল ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকে, সে গুনাহমুক্ত হয়ে ফিরে আসে যেন নবজাত শিশুর মতো।” — সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৫২১
৩. হজ ও কেবলার গুরুত্ব:
কা’বা মুসলমানদের কেবলা—নামাজ, হজ, ও কুরবানি এই কেন্দ্র ঘিরেই আবর্তিত।
হজ মুসলমানদের একতা, ভ্রাতৃত্ব ও তাওহিদের প্রকাশ—সব জাতি, বর্ণ এক জামাতের অংশ।
হজে গিয়ে কেবলার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ নিজের গুনাহর ক্ষমা চায়, আত্মার পরিশুদ্ধি লাভ করে।
৪. গুরুত্বপূর্ণ উপসংহার:
হজ ও কেবলা মুসলমানের জীবনে শুধু এক ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং তা হলো ঈমান, তাওহিদ ও ইসলামী ঐক্যের প্রতীক। হজের মাধ্যমে মানুষ আত্মিক প্রশান্তি, গুনাহমুক্ত জীবন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে।
হজের আহকামসমূহ
পরিভাষা ও গুরুত্ব:
হজ শব্দের অর্থ ইচ্ছা করা, উদ্দেশ্য করা। পরিভাষায় হজ হলো:
“নির্ধারিত সময়ে, নির্ধারিত স্থানে গিয়ে নির্দিষ্ট কিছু ইবাদত সম্পাদন করা।”
হজ ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। প্রত্যেক সক্ষম মুসলমান নর-নারীর জীবনে একবার হজ পালন করা ফরয।
আল কুরআনে ইরশাদ:
“মানুষের মধ্যে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের ওপর আল্লাহর জন্য কাবাঘরের হজ করা ফরজ।”
[সূরা আলে ইমরান: ৯৭]
হজের শর্তসমূহ (যার মাধ্যমে হজ ফরয হয়):
১. মুসলিম হওয়া
২. প্রাপ্তবয়স্ক (বালেগ) হওয়া
৩. বিবেকবান হওয়া
৪. স্বাধীন হওয়া
৫. হজের খরচ বহন করার সামর্থ্য থাকা
৬. পথ নিরাপদ হওয়া
৭. নারীদের জন্য মাহরাম থাকা

হজের প্রকারভেদ:
১. হজে ইফরাদ – শুধু হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে হজ করা।
২. হজে কিরান – উমরাহ ও হজ এক ইহরামে পালন করা।
৩. হজে তামাত্তু – উমরাহ করে ইহরাম খুলে হজের সময় আবার নতুন ইহরামে হজ করা।
হজের সময়কাল:
শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ – এই তিন মাসকে “আশহুরে হজ” বলা হয়।
হজের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী মূলত ৮ থেকে ১৩ জিলহজের মধ্যে সম্পন্ন হয়।
হজের ফরয ৩টি:
১. ইহরাম – হজের নিয়ত ও তালবিয়া পাঠ করে ইহরামে প্রবেশ করা।
২. আরাফার ময়দানে অবস্থান – ৯ জিলহজ সূর্য ডোবার আগে কিছু সময় থাকলেই যথেষ্ট।
৩. তাওয়াফে জিয়ারত – ১০ জিলহজ ঈদের দিন বা পরে কাবা শরীফ ৭ চক্কর দেয়া।
এগুলোর যে কোনো একটি বাদ পড়লে হজই শুদ্ধ হবে না।
হজের ওয়াজিবসমূহ:
১. সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাঈ করা
২. মুযদালিফায় অবস্থান করা
৩. মিনায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা (রামি জামারাত)
৪. কোরবানি করা (হজে তামাত্তু ও কিরানে)
- হালক বা কসর করা (চুল কাটানো)
- তাওয়াফে বিদা (বিদায় তাওয়াফ)
- ইহরামের নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে বেঁচে থাকা
কোনো ওয়াজিব ছুটে গেলে হজ শুদ্ধ হবে তবে দম (জবাই) দিতে হবে।
হজের সুন্নতসমূহ:
১. ৮ জিলহজ মিনায় গিয়ে রাত যাপন করা
২. তালবিয়া বারবার পাঠ করা
৩. আরাফার খুতবা শ্রবণ করা
৪. আরাফা ও মুযদালিফায় বেশি বেশি দোয়া করা
৫. জামায়াতে নামাজ পড়া ও নিয়ম মেনে চলা
৬. হালক করানো (সম্পূর্ণ মাথা মুন্ডানো)
৭. গুনাহ থেকে বিরত থাকা, উত্তম ব্যবহার করা
ইহরাম:
হজের জন্য নির্ধারিত পোশাক ও নিয়ত সহকারে ‘মীকাত’ থেকে ইহরাম বাঁধা আবশ্যক।
পুরুষদের জন্য ২ টুকরো কাপড়, নারীদের সাধারণ পর্দাশীল পোশাক।
ইহরামের কিছু নিষেধ:
চুল কাটা বা নখ কাটা
সুগন্ধি ব্যবহার
শিকার করা
বিবাহ বা বিবাহ পড়ানো
ঝগড়া, গালমন্দ
সেলাই করা কাপড় পরা (পুরুষদের জন্য)
হজের ধাপসমূহ:
৮ জিলহজ (ইয়াওমুত তরবিয়া):
ইহরাম বেঁধে মিনায় যাওয়া
মিনায় ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া
রাত মিনায় যাপন
৯ জিলহজ (আরাফার দিন):
ফজর পড়ে আরাফায় যাওয়া
দুপুরে খুতবা ও নামাজ
দোয়া, কান্না, ক্ষমা চাওয়া
সূর্যাস্তের পর মুযদালিফায় যাওয়া
মাগরিব-ইশা একত্রে আদায়
রাতে মুযদালিফায় থাকা
১০ জিলহজ (ঈদের দিন):
মিনা গিয়ে বড় জামারায় ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ
কোরবানি
মাথা মুন্ডানো বা চুল কাটা
ইহরাম খোলা
কাবা শরিফে গিয়ে তাওয়াফে জিয়ারত
সাঈ করা
১১-১২ জিলহজ (তাশরীক):
তিন জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ
রাতে মিনায় থাকা
চাইলে ১৩ তারিখেও থাকা যায়, এটি সুন্নাত।
হজের গুরুত্বপূর্ণ আদব ও পরামর্শ:
সবকিছু নিয়ম ও সময়মতো করা
গুনাহ, ঝগড়া, অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকা
ধৈর্য ও সহনশীলতা বজায় রাখা
কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া, ইস্তিগফার করা
সাথীদের সহযোগিতা করা
ফিকহ ও মাসআলা জানা থাকা
নারীদের হজ সংক্রান্ত বিশেষ বিধান:
মাহরাম ছাড়া হজ করা জায়েয নয়
হায়েয অবস্থায় তাওয়াফ জায়েয নয়, তবে আরাফায় থাকা যাবে
চেহারা ও হাত না দেখিয়ে পর্দা রক্ষা করা
হজ না করার ক্ষতি:
যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ করে না, তার ব্যাপারে কঠিন হাদিস এসেছে।
রাসূল (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি হজ করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ না করে, সে ইহুদি কিংবা খ্রিস্টান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করুক, তাতে কিছু আসে যায় না।”
[সুনানে দারিমি: ১৭৭৪]
উপসংহার:
হজ ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি আত্মার পরিশুদ্ধি, গুনাহ থেকে মুক্তির এক অপূর্ব সুযোগ। হজ পালনে রয়েছে জান্নাত লাভের সুসংবাদ, আর তা যদি নিয়ম অনুযায়ী ও আন্তরিকতার সাথে পালন করা হয়— তবে হজ মানুষকে এক নবজাতকের মতো নির্মল করে দেয়।
হাদিসের আলোকে হজের ১০টি বিস্ময়কর তথ্য
১. হজ গুনাহ মুছে দেয়
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করে এবং অশ্লীলতা ও গুনাহ থেকে দূরে থাকে, সে এমনভাবে (পাপমুক্ত) ফিরে আসে যেভাবে তার মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছিল।”
(সহীহ বুখারী: ১৫২১)
২. হজ জান্নাতের ওয়াদা এনে দেয়
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“একটি মাবরূর হজের প্রতিদান শুধু জান্নাত।”
(সহীহ বুখারী: ১৭৭৩, সহীহ মুসলিম)
৩. হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত:… এবং হজ করা।”
(সহীহ বুখারী: ৮, সহীহ মুসলিম: ১৬)
৪. হজ সবধরনের গুনাহ মুছে দেয়
রাসূল (সা.) বলেন:
“উমরাহ এক উমরাহের মধ্যে যা গুনাহ হয়েছে তা মুছে দেয়। আর মাবরূর হজের প্রতিদান শুধু জান্নাত।”
(সহীহ বুখারী: ১৭৭৩)
৫. হজের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ আসে
হাদিসে এসেছে:
“হজ ও উমরা পালনকারীরা আল্লাহর অতিথি। তারা যদি তাঁর কাছে কিছু প্রার্থনা করে, তিনি তা কবুল করেন।”
(সুনান ইবনু মাজাহ: ২৮৯২)
৬. আরাফাতের দিনে আল্লাহ বান্দাদের গর্ব করেন
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“আরাফার দিনের চেয়ে আল্লাহ বান্দাদের নিয়ে গর্ব করার আর কোনো দিন নেই।”
(সহীহ মুসলিম: ১৩৪৮)
৭. হজ মুসলিমদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বড় নিদর্শন
মিল্লাতের বর্ণ, জাতি, গৌরবের পার্থক্য ছাড়িয়ে সবাই একই কাপড়ে, একই স্থানে, একই নিয়মে সমবেত হয়।
৮. হজ ধৈর্য, ত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মহাসমর
রাসূল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন:
“সর্বোত্তম ইবাদত হচ্ছে ধৈর্য সহকারে হজ পালন করা।”
(আবু দাউদ)
৯. হজের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদত
মিনা, আরাফা, মুজদালিফা — প্রতিটি স্থান ও সময় হজের অংশ; এখানে ঘুমানো, চলাফেরা করাও ইবাদত হয়ে যায়।
(সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
১০. হাজী দোয়া করলে কবুল হয়
রাসূল (সা.) বলেন:
“হাজী যখন দোয়া করে তখন তার দোয়া ফেরানো হয় না।”
(মুসনাদ আহমদ: ৭৪৫৩)